শফিকের খুব বেশি চাহিদা ছিল না। লেখাপড়া শেষে কেবল একটা চাকরি। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ বাবা। বাবার বয়স হয়ে গিয়েছে। খুব বেশি দিন সংসার টেনে নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। ওদিকে শফিকের লেখাপড়ার পাটও চুকে গেছে অনেক দিন হলো। কিন্তু এখনও একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেননি। বাড়িতেও যেতে পারছেন না। বাবার সামান্য কিছু জমিজমা আছে। কিন্তু লেখাপড়া করেছেন বলে বাড়িতে গিয়ে বাবার মতো জমিজমার কাজও করতে পারছেন না।
তরুণ কৃষি-উদ্যোক্তা জামালের কথাই ধরা যাক। লেখাপড়া শিখেও চাকরি না পেয়ে কিছুদিন হতাশ ছিলেন। হতাশা কাটিয়ে এরপর তিনি কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে চলে গেলেন। পৈতৃক যতটুকু জমি আছে, সেটাকেই কাজে লাগালেন বুদ্ধি করে। অল্প জমিতে প্রচলিত ফসল উৎপাদন করে লাভ হবে না জানতেন তিনি। অফট্র্যাকের ফসল উৎপাদন শুরু করলেন জামাল। এই অফট্র্যাকের ফসলের যেমন চাহিদা, তেমনি এর মুনাফাও ভালো। কয়েক বছরের মধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন জামাল।
এই জামালের কয়েক বন্ধু আছেন। তারা এখনও চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। হতাশায় জর্জরিত হয়ে তাদের কেউ কেউ এখন আর বড় কোনো স্বপ্নও দেখেন না। কোনো রকমে দিন কাটানোর মতো কিছু একটা করতে চান। ওদের সবার সামনে জামাল উদাহরণ। কিন্তু কেন যেন ওরা সেদিকে পা বাড়াননি। চাকরি করার চেয়ে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করার ইচ্ছে কিংবা আগ্রহ সবার থাকে না।
যুবকরাই হচ্ছে একটি পরিবারের মেরুদণ্ডের মতো। আর একটি দেশের বা সমাজের উন্নতি ও অবকাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে যুবকদের কর্মদক্ষতার ওপর। তবে যুবকদের কাছ থেকে সুফল পেতে হলে তাদের কাজের সুযোগ দিতে হবে।
আর সুফলের সিংহভাগ পেতে হলে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কিন্তু যুবকরা যদি কর্মহীন হয়ে থাকে, সেটা কারও জন্যই ভালো নয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্যিটা হলো এই অতিমারির দুঃসময়ে কর্মহীন যুবকদের পরিস্থিতি ভয়ানক রকমের শোচনীয়। বড়ই বিষাদময়, যন্ত্রণাময়, করুণ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে দেশের মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ ছিলেন কর্মজীবী। বাকি ২৭ লাখ বেকার।
২০১৭ সালের হিসাবের সঙ্গে ২০২১ সালের পরিসংখ্যান কোনোভাবেই মিলবে না। চার বছরে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কর্মহীন যুবকের সংখ্যাও। আর কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাসের কারণে বেকার যুবকের সংখ্যা অন্য সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
সরকারি হিসাবে দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। যুব বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। এটা ছিল করোনা পরিস্থিতির আগের হিসাব। এখন সেটা কতখানি বেড়েছে, সে হিসাব হয়নি। তবে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাস সংকটের কারণে বিশ্বে প্রতি ছয়জনে একজন বেকার হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি চার যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন। যতই সময় গড়াচ্ছে, বেকারত্বের সংখ্যা ততই বাড়ছে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে আর্ন্তজাতিক ওই সংস্থা। সংস্থাটির মতে, করোনা মহামারিতে তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্বের যুব সম্প্রদায়। একে তো বেকার, তার ওপর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। নেই প্রশিক্ষণ নেয়ারও সুযোগ।
যদিও আইএলওর সংজ্ঞা অনুসারে সপ্তাহে এক দিন বা এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যার কথা যদিও ২৭ লাখ বলা হতো, বিশেষজ্ঞদের মতে সে সংখ্যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি। আর এখন বেড়ে নিশ্চয়ই চোখ কপালে তোলার মতো সংখ্যায় গিয়ে ঠেকেছে।
মহামারির কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে, সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত রয়েছে। নতুন নিয়োগ তো বলতে গেলে বন্ধই হয়ে আছে। তার ওপর নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া আছে যেসব জায়গায়, সেখানে চাওয়া হচ্ছে অভিজ্ঞ কর্মী। একেবারে নতুনদের চাহিদা নেই বললেই চলে। এটা কতদিন চলবে, কেউ জানে না। সবকিছুই নির্ভর করছে মহামারির গতিবিধির ওপর।
এই মহামারিকালে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব যুবদক্ষতা দিবস।’ প্রতিবছর ১৫ জুলাই দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি পালনের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ২০১৫ সাল থেকে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আলাদা বাণীও প্রকাশ করা হয়। দিবসটি পালনে জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য ছিল, তরুণদের মাধ্যমে বিশ্ব পরিবর্তনের সূচনা করা।
এ জন্য তরুণদের কারিগরি, পেশামূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমনভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা, যাতে ব্যক্তি ও বেসরকারি পর্যায়ে তরুণদের কর্মদক্ষতা ও উদ্যোগের গুরুত্ব তৈরি হয়। কাজের জায়গা যাতে আরও বাড়ানো যায় এবং পরিবেশকে যাতে আরও উৎপাদনশীল করা যায়। কারণ, আগামী বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ তরুণরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবসকে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পালন করছে। গত বছর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আয়োজনে বিশ্ব যুব দিবসের অনুষ্ঠানে দেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেছিলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে কেউ কর্মহীন থাকবে না।’
প্রতিমন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘ-ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অর্জন করতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। এ জন্য দেশে যুব সমাজকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
ইউনেস্কোর হিসাবে বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ স্কুল-শিক্ষার্থীর লেখাপড়া মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। বেকার তরুণদের সংখ্যাও বাড়ছে। এমন দুঃসময়ে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তরুণদের সহায়তা খুবই জরুরি। তরুণরা তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জিং সময়কে মোকাবিলা করে বিশ্বকে আবার গতিময় করে তুলবে।
তরুণদের সক্রিয় দক্ষতায় আবার চাঙা হবে আঞ্চলিক ও বিশ্ব অর্থনীতি। আর সে কারণেই এবারে বিশ্ব যুবদক্ষতা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘রিমেইনিং ইয়ং স্কিলস পোস্ট-প্যান্ডামিক’ (মহামারি-উত্তর যুবদক্ষতা বিষয়ে পুনর্ভাবনা)। অর্থাৎ অতিমারির পর তরুণদের দক্ষতাকে নতুন করে বিবেচনায় আনতে হবে।
সাধারণত ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের কথা বিবেচনায় এনেই পালন করা হয় বিশ্ব যুবদক্ষতা দিবস। একজন মানুষ দক্ষ হয়ে ওঠার এটাই আসল বয়স। এ বয়সে যে তরুণ যে কাজের প্রতি আগ্রহী, সে কাজে দক্ষ হয়ে ওঠাই যদি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়, আর যদি তাকে সে কাজে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা যায়, তবে সে দক্ষ তরুণ নিজের জন্য যেমন, তেমনি তার সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠবে।
সিই দক্ষ তরুণই একসময় হয়ে উঠবে তুখোড় পেশাজীবী, ব্যক্তি উদ্যোক্তা, পরিকল্পনাকারী কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থাপক। তবে খুব বেশি ভবিষ্যতের কথা আপাতত ভাববার অবকাশ নেই। অতিমারির কবল থেকে মুক্ত হওয়াটাই এখন প্রধান লক্ষ্য। অতিমারিতে কাবু অর্থনীতির প্রভাবে পাল্টে গেছে দুনিয়ার অনেক হিসাবনিকাশ। বদলে গেছে অনেক পরিসংখ্যান। শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় ঘটছে দেশে দেশে। কাজেই করোনা-পরবর্তী সময়ে দ্রুত ক্ষতি পুষিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল করার সঙ্গে সঙ্গে, আবার স্বাভাবিক হওয়ার দৌড়ে অংশ নিতে দক্ষ যুবারাই একমাত্র ভরসা।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক-প্রবন্ধকার, কলাম লেখক